জনতার আলো, কোটচাঁদপুর (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি : যশোরের কোটচাঁদপুর সরকারি জয়দিয়া বাওড় মৎস্য অধিদপ্তরের অধীন বিল বাওড় মৎস্য উন্নয়ন প্রকল্প ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে থাকা সহকারি হ্যাচারী অফিসার আব্দুল মাবুদ বাওড় থেকে আহরণকৃত মাছের গ্রেড, প্রজাতি ও দরহার পরিবর্তন করে সরকার নির্ধারিত লক্ষমাত্রা পূরণের নামে চালিয়ে যাচ্ছেন যথেচ্ছ লুটপাট। ভূমি মন্ত্রনালয়ের প্রতিনিধি স্থানীয় নায়েব অফিসকে ম্যানেজ করে তিনি সমানে লোপাট করছেন সরকারি রাজস্ব।
এক্ষেত্রে বাঁধার সম্মুখিন হলেই তিনি স্থানীয় নির্বাহী অফিসারের দোহাই দিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করেন। সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানাযায়, বাওড়ের আহরণকৃত মাছ বাজারজাত করছেন স্থানীয় বাওড় কর্তা অথবা তার প্রতিনিধি।
নির্বাহী অফিসারের মনোনীত স্থানীয় নায়েব অফিস ও জেলে প্রতিনিধি। বিক্রিকৃত মাছের ৩৫ শতাংশের মালিক মৎস্য অধিদপ্তর। ২৫ শতাংশ ভূমি মন্ত্রনালয় ও বাকী ৪০ শতাংশ মৎস্যজীবিরা পেয়ে থাকেন।
সরকারি এ বাওড়টিতে রেনুপোনা উৎপাদন থেকে শুরু করে মাছ আহরণ ও বিক্রি কোনটাতেই বাওড় ম্যানেজার সরকারি নীতিমালার কোন ধার ধারছেন না। বাওড়ের পোনা তৈরী করার জন্য পার্শ্ববর্তী চতুরপুরে রয়েছে মৎস্য বিভাগের হ্যাচারী সহ ৯টি পুকুর।
নির্দেশনা রয়েছে এখান থেকে প্রতিবছর ১৫ মেট্রিক টন পোনা উৎপাদন করে বাওড়ে ছাড়ার। কিন্তু এ নির্দেশনা উপেক্ষা করে ব্যবস্থাপক আব্দুল মাবুদ বাওড়ে কর্মরত মাষ্টাররোল কার্ডদের কাছে অলিখিতভাবে লিজ দিয়েছেন।
বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে লিজ বাবদ ৮ মেট্টিকটন পোনা মাছ নিচ্ছেন প্রতি মৌসুমে। সরকারি এ প্রতিষ্ঠান লিজ নিয়ে গার্ডরা চুটিয়ে ব্যবসা করছেন। বাওড় ব্যবস্থাপকও পাচ্ছেন ভাগার অংশ।
অন্যদিকে রেনুপোনা উৎপাদনের জন্য মৎস্য অধিদপ্তর গত বছর সাড়ে ৭ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়। পুকুরগুলো লিজ দেওয়ায় পোনা উৎপাদনে করতে হচ্ছে না কোন খরচ।
বরাদ্দের অর্থ ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থাপক উত্তোলন করে আত্মসাত করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। বাওড়ে পোনা ছাড়ার লক্ষমাত্রা পূরণ করতে তিনি কৌশলে জেলে দল পতিদের মাধ্যমে বাহির থেকে পোনা কিনে বাওড়ে ছেড়েছেন।
যা আহরণকৃত মাছের বিক্রি করা টাকা থেকে পরিশোধ করেন। বাওড়েরর মৎস্যজীবি ও স্থানীয়দের সাথে আলাপ করলে তারা সাংবাদিকদের কাছে বিষয়টি অকোপটে স্বীকার করেন।
বাওড় থেকে ধরা মাছ তোলা, ওজন, চালান ও বিক্রির জন্য রয়েছে মৎস্য বিভাগের নিদৃষ্ট একটি বিক্রয় কেন্দ্র। কিন্তু বাওড় ব্যবস্থাপক উক্ত স্থানে মাছ না তুলে প্রায়ই বাওড়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে মাছ গাড়িতে ভরে বাজারে পাঠাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে মাছের গ্রেড, প্রজাতি নির্নয় ও ওজন করছেন না। পার্শ্ববর্তী অসংখ্য মাছ বাজারে মাছ বিক্রির সুযোগ থাকলেও তিনি রহস্য জনকভাবে ঝিনাইদহের বারোবাজারের দুটি আড়তে সিংহভাগ মাছ বিক্রি করছেন।
সূত্রের অভিযোগ এ বিশেষ দুটি আড়তের সাথে হাত রেখেই তিনি ইচ্ছামত মাছের গ্রেড, প্রজাতি, ওজন ও দর প্ররিবর্তন করে ভূয়া ভাউচার নিচ্ছেন। বিগত বছরগুলোতে এ বাওড়ে কর্তৃপক্ষ ১’শ টনেরও বেশি লক্ষমাত্রা ছিল।
কিন্তু অজ্ঞাত কারণে গত ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে লক্ষমাত্রা নির্ধারণ হয় ৮১ মেট্টিকটন। যা চলতি ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে মাত্র ৪টন বাড়িয়ে করা হয়েছে ৮৫ মেট্টিকটন।
অনেকেই এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের বিষয়টিকে উদ্দেশ্য প্রনোদিত ও হাস্যকর বলে মনে করছেন। বর্তমান বাওড় ব্যবস্থাপক গত ২০১৬ সালের ১৩ নভেম্বর এ বাওড়ে যোগদান করেন।
এ অ লে মাছের অভয়ারণ্য খ্যাত কোটি টাকার রাজস্বের এ প্রকল্পে সহকারি হ্যাচারী অফিসার আব্দুল মাবুদকে পদায়ন করেন। এ বিভাগে অসংখ্য প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা থাকার পরও সহকারি হ্যাচারী অফিসারকে বাওড় ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব দেওয়ায় সৃষ্টি করেছে নানাপ্রশ্নের। তারপরও তাকে সহায়তা করার জন্য শুধুমাত্র একজন মহিলা ক্ষেত্র সহকারি রয়েছেন। যিনি বাওড় দেখভালের প্রয়োজনে সব সময় কাজ করতে পারছেন না। মৎস্য বিভাগ স্থানীয় ভোক্তাদের মাঝে মাছ বিক্রির জন্য ৮০’র দশকে একটি মূল্য তালিকা প্রস্তুত করেন। যা এখনও বিদ্যমান আছে।
এখানে সিলভারকার্প ৫’শ থেকে ১ কেজি পর্যন্ত ৭০ টাকা, ১ কেজি ১’শ থেকে ২ কেজি পর্যন্ত ১১০ টাকা, ২ কেজি ১’শ থেকে ৩ কেজি পর্যন্ত ১২০ টাকা, ৩ কেজি ১’শ থেকে ৪ কেজি পর্যন্ত ১৫০ টাকা এবং তার উপরে ২০০ টাকা। একই নিয়মে গ্রাস, ব্লাক, কমনকার্প ১২০, ১৫০, ১৮০, ২০০ ও ২৫০ টাকা। মৃগেল, কাতলা ১২০, ১৭০, ২০০, ২৫০ ও ৩৫০ টাকা এবং রুই, ১৫০, ২০০, ২৫০, ৩০০ ও ৪০০ টাকা কেজি প্রতি দর নির্ধারণ রয়েছে। এ বাওড়ে জেলেদের ১৩টি কোমর রয়েছে।
প্রতি বছর আহরণকৃত মাছের সিংহভাগ এখান থেকে আসে। বাকি মাছ ধরা হয় কচাল জালের মাধ্যমে। এলাকাবাসী জানান, প্রতি বছর এ কোমরগুলো থেকে ৪ কেজি থেকে ১২ কেজি পর্যন্ত রুই, কাতলাসহ কার্প জাতীয় মাছ আহরণ হয়।
প্রজাতি ভেদে প্রতি কেজি মাছের বিক্রি দাম আসে ৪০০, ৬০০ ও ৮০০ টাকা। এভাবে কোমর থেকেই গড়ে কমপক্ষে ১২০০ ও কচাল থেকে ৬০০ বড় মাছ ধরা পড়ে। যার নূন্যতম বাজারমূল্য অর্ধকোটি টাকা।
শুধুমাত্র ১৮’শ পিচ মাছের গড় ওজন আসে ৯ মেট্টিকটন। এছাড়া জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত দুই দফায় কচাল জালের মাধ্যমে মাছ ধরা হয়। গত বছর খাওয়ার মাছ বাবদ নেওয়া জেলেদের মাছ থেকেই বাওড় ব্যবস্থাপক ৪ লক্ষ ১৬ হাজার টাকা আত্মসাত করেছেন।
যা এলাকাবাসীর সাথে আলাপকালে বেরিয়ে আসে। গত বছর লক্ষ্যমাত্রা পূরণের নামে ৮১ মেট্টিকটনের বিপরিতে ৫৬ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেখিয়েছেন।
ব্যবস্থাপক প্রদত্ত হিসাবে দেখা যায়, এ বাওড়ে শুধুমাত্র ৫’শ গ্রাম থেকে ১ কেজি পর্যন্ত সিলভারকার্প মাছ উৎপাদন হয়েছে। বাওড়ে রুই, মৃগেল, কাতলা, ব্লাক, গ্রাস, কমনকার্প জাতের ১ ছটাক মাছের উৎপাদন ও দেখানো হয়নি।
বাওড় ব্যবস্থাপকের এই সাজানো হিসাবশুনে স্থানীয়রা রিতিমত চমকিত হচ্ছেন। জেলে মাতব্বরা জানান, আহরণকৃত মাছের ৫০ শতাংশ রুই, কাতলা, মৃগেল, কমন, গ্রাস, ব্লাক মাছ হয়ে থাকে। অথচ ব্যবস্থাপক সিলভারকার্প ছাড়া কোন মাছ এখানে উৎপাদন হয়না বলে প্রতি বছর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে উল্লেখ করে আসছেন। অভিযোগ রয়েছে, মোটা অংকের অর্থ বাণিজ্য করতেই তিনি পরিকল্পিতভাবে এ কাজটি করছেন।
বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন, প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ অবহিত রয়েছেন। এভাবেই বাঁধাহীন ভাবে সরকারি রাজস্ব তসরুফ করা অংশ মিলেমিশেই ভাগ বাটোয়ারা করে নিচ্ছেন। চলতি বছর বাওড়ে লক্ষ্যমাত্রা ৮৫ মেট্টিকটন। গত ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত কচাল ও ৬টি কোমর থেকে কাগজ কলমে ৬২ মেট্টিকটন মাছ আহরণ দেখিয়েছন।
প্রকৃতপক্ষে আহরণ হয়েছে এর দ্বিগুন। এ ব্যাপারে বাওড় ব্যবস্থাপক আব্দুল মাবুদ সাংবাদিকদের জানান, আমি বাওড় প্রজেক্টে কখনও চাকুরী করিনি। সাবেক প্রকল্প পরিচালক রমজান আলী আমাকে এখানে বদলি করে সর্বনাশ করেছেন। তবে বাওড়ে চাকুরী করতে গেলে একটু অনিয়ম করতেই হয়।
মাছ বিক্রির সরকারি পাকা চালান ও মানি রশিদ ব্যবহার না করার কথা স্বীকার করে বলেন, তাৎক্ষনিকভাবে মানি রশিদ ও চালান না করলেও সুযোগমত সময়ে আমরা তা করে থাকি। সরকারের বৃহৎ রাজস্ব আয়ের এ প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর কোটি টাকা লোপাট হলেও রয়েছে কর্তৃপক্ষ নিরব।
সচেতন এলাকাবাসী বিষয়টি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য দূর্ণীতি দমন কমিশন সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
জনতার আলো/রবিবার, ২৯ এপ্রিল ২০১৮/শাহানা
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.