জনতার আলো, স্টাফ রিপোর্টার: চলতি বছরের ১৩ অক্টোবর বিএনপিসহ কয়েকটি দল নিয়ে গঠিত হয় ঐক্যফ্রন্ট। দুই দফা তারিখ পেছানোর পর অবশেষে রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ইশতেহার ঘোষণা চলছে। ইশতিহারে দেয়া হচ্ছে ১৪টি প্রতিশ্রুতি।
সোমবার বেলা ১১টা ২৬ মিনিটে রাজধানীর পূর্বাণী হোটেলে ইশতেহার পাঠ শুরু করেন নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না।
ইশতেহারের বলা হয়, নির্বাচনে জিতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পেলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট রাষ্ট্রের সকল নাগরিক কল্যাণে সরকার পরিচালনা করবে। এই পরিচালনার মূলনীতি হবে ঐকমত্য, সকলের অন্তর্ভুক্তি এবং যেকোনো রকম প্রতিহিংসা থেকে মুক্ত থাকা।
১. প্রতিহিংসা বা জিঘাংসা নয়, জাতীয় ঐক্যই লক্ষ্য
বিগত ১০ বছরে কল্পনাতীত স্বেচ্ছাচারিতা এবং পুলিশকে দলীয় ক্যাডার হিসেবে ব্যবহার করে হাজার হাজার মিথ্যা মামলায় ঘুষ বাণিজ্য ও বিচারবহির্ভূত হত্যায় লাখ পরিবার ক্ষুব্ধ এবং বিপর্যস্ত। এই সমস্যা সমাধান করে সামাজিক শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সমাজকর্মী, আইনজীবী সমন্বিত সর্বদলীয় সন্ধান ও বিভেদ নিরসন কমিশন গঠন করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের অতীতের হয়রানি মামলা করার লক্ষ্যে খোলা মনে আলোচনা করে ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হবে।
সকল জাতীয় বীরদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত করে স্কুল কলেজে পড়ানো হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করা হবে। একদলীয় শাসন যেন পুনর্জন্ম না ঘটে তা নিশ্চিত করা হবে।
২. নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুম পুরোপুরি বন্ধ করা হবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করা হবে। রিমান্ডের নামে পুলিশি হেফাজতে যে কোনো প্রকার শারীরিক নির্যাতন বন্ধ করা হবে। সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেফতার করা হবে না। মিথ্যা মামলার অভিযুক্তদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে এবং মিথ্যা মামলার সহায়তাকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের ক্ষেত্রে সকল নারীর উপর বাচিক কিংবা শারীরিক যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স দেখানো হবে। যৌতুক পুরোপুরি বন্ধ করা হবে। মামলাজট কমানোর নানা পদক্ষেপের সঙ্গে উচ্চ আদালতের বাৎসরিক ছুটি ছয় সপ্তাহে সীমিত করা হবে।
সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানবিক মর্যাদা অধিকার নিরাপত্তা এবং সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। তাদের ওপর যেকোনো রকম হামলার বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম চলমান থাকবে।
৩. ক্ষমতার ভারসাম্য
নির্বাচনকালীন সরকারের বিধান তৈরি করা, নির্বাচন কমিশনকে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা দেয়াসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমে মুক্তভাবে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের অধিকার নিশ্চিত করা হবে। সংসদে একটি উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা হবে। সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ৭০ অনুচ্ছেদের পরিবর্তন আনা হবে।
প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনা হবে। একটানা পরপর দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকা যাবে না। সংসদের ডেপুটি স্পিকার বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত হবে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সভাপতির পদ সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক বিরোধীদলের জন্য নির্দিষ্ট থাকবে।
আইন ও রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন এবং পর্যালোচনাই হবে সংসদ সদস্যদের মূল কাজ। সংসদে বিরোধীদলের মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে জাতীয় কমিশন গঠন এবং ন্যায়পাল নিয়োগসহ বিরোধীদলের মতকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়া হবে। সকল সাংবিধানিক পদে নিয়োগের জন্য সুস্পষ্ট আইন তৈরি করা হবে। ন্যায়পাল, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিসহ সব নিয়োগের জন্য বিরোধীদলীয় সংসদ এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের সমন্বয়ে স্বাধীন কমিশন গঠন করা হবে।
সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হবে। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হবে। তবে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের জন্য সকল রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ন্যূনতম ২৩ শতাংশ নারীর মনোনয়ন দেয়া বাধ্যবাধকতা থাকবে। বাংলাদেশের প্রাদেশিক সরকার প্রতিষ্ঠার যুক্তিকতা পরীক্ষার জন্য একটি সর্বদলীয় জাতীয় কমিশন গঠন করা হবে।
৪. ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ
দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব থাকবে নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের হাতে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা হবে। বর্তমানে কমবেশি ৫ শতাংশ বাজেট স্থানীয় সরকারের মাধ্যমিক ব্যয় এর পরিবর্তে প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে বাড়িয়ে পাঁচ বছরে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ বাজেট স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে ব্যয় এর বিধান করা হবে। জেলা পরিষদ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবে। পুরো এলাকাগুলোতে এসব সেবা সংস্থা মেয়রের অধীনে রেখে সিটি গভর্নমেন্ট চালু করা হবে। জনকল্যাণে প্রশাসনিক কাঠামো প্রাদেশিক পর্যায়ে বিনষ্ট করা এবং স্থানীয় সরকারের স্তর নির্ধারণের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করা হবে।
৫. দুর্নীতি দমন এবং সুশাসন
এই সরকারের আমলে দুর্নীতির তদন্ত করে তার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা হবে। ন্যায়পাল নিয়োগ করা এবং সাংবিধানিক নির্দেশিত সব দায়িত্ব পালনে ন্যায়পালকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হবে। দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা গ্রেফতারে সরকারের অনুমতি লাভের বিধান বাতিল করা হবে। অর্থপাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বর্তমানে চলমান কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করা হবে না কিন্তু বর্তমান সরকারের শেষ দুই বছর তড়িঘড়ি করে নেয়া প্রকল্পগুলো পুনর্বিবেচনা করার জন্য কমিটি গঠন করা হবে। বর্তমানে চালু থাকা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ব্যয় নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ব্যাংকিং সেক্টরে লুটপাটে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে এবং ব্যাংকগুলোকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হবে। সরকারি মদদে শেয়ারবাজারে লুটপাটে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। সঠিক ব্যবস্থা এবং প্রণোদনার মাধ্যমে শেয়ার বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করে শেয়ারবাজারকে তার সঠিক গতিপথে নিয়ে যাওয়ার সব ব্যবস্থা খুব দ্রুত নেয়া হবে।
দেশের ক্রিয়া সংস্থা ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতির বাইরে রেখে পেশাগতভাবে গড়ে তোলা হবে। ভিনদেশি ও ক্ষতিকর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য দৃঢ় ও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষা এবং প্রসারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ইশতেহার পাঠে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত আছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষনেতা ড. কামাল হোসেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আ স ম আবদুর রব, নজরুল ইসলাম খান, মাহমুদুর রহমান মান্না, সুব্রত চৌধুরী, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মোস্তফা মহসিন মন্টু, ড. রেজা কিবরিয়া প্রমুখ।
জনতার আলো/সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮/শোভন
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.