জনতার আলো, ইকবাল হোসেন জীবন, মিরসরাই প্রতিনিধি : ওদের চোখে আলো নেই। অথচ বাই সাইকেল চালনা, সুচারুভাবে বৈদ্যুতিক কাজ করা, অনেক উঁচু গাছগাছালিতে চষে বেড়ানো, খেতখামারের কাজ করা, মাইকিং করা যেন কোন ব্যাপারই না তাদের কাছে। কেউ জন্মগত কেউবা ভুল চিকিৎসায় হারিয়েছে চোখের আলো। তবুও ওরা বোঝা নয় পরিবার-সমাজের কাছে। মেজবা ও হিরো নামের দুই যুবক আজ মিরসরাইয়ের বিস্ময়। ওদের নিয়ে নিজেদের গ্রামে যেমন কৌতুহলের শেষ নেই, তেমনি আছে বুকভরা গর্বও।
সাইকেল চালনায় পারদর্শী হিরো :
মুক্তিযোদ্ধা বাবার অভাবের ঘরে ছয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয় ইসমাঈল হোসেন হিরো। ছয় বছর বয়সে হাম রোগে আক্রান্ত হলে কবিরাজের ভুল চিকিৎসায় দুই চোখের দৃষ্টি চিরকালের জন্য হারিয়ে যায়। অভাবের সংসারে হিরোর এমন পরিণতিতে ভেঙে পড়েন বাবা-মা। তবুও চট্টগ্রামের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলে পড়াশুনা শুরু করেন। সেখানে প ম শ্রেণির গণ্ডি আর পার হওয়া যায়নি। ধীরে ধীরে শুরু হয় জীবন গড়া। বিয়ে হয়, দাম্পত্য জীবনে রয়েছে দুটি সন্তান। স্ত্রী আয়শা বেগমও প্রতিবন্ধী স্বামীকে নিয়ে সুখে আছেন। তার বাড়ি মিরসরাই উপজেলার মিঠানালা ইউনিয়নে।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিরো নিজেকে বিস্ময় হিসেবে আবিস্কার করতে থাকেন মাত্র ১০ বছর বয়সে। একদিন গ্রামের মানুষ তাকে সাইকেল চালাতে দেখে অবাক না হয়ে পারেননি। পরে সেটি তার ক্ষেত্রে স্বাভাবিকই হয়ে উঠেছে। জানা গেছে, হিরো বেশ স্বাভাাবিক নিয়মে সাইকেল চালিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি যেতে পারেন। খুব সহজে নিজের আত্মীয়-পরিজনদের ঠিকানা খুঁজে নিতে পারেন। হিরোর আছে মোবাইল ফোন। ফোনের কোন বাটন কোথায় আছে, অপশনের ভেতরের অপশন খুঁজে প্রয়োজন মেটাতে তার কারো সাহায্য লাগে না। নারকেল, সুপারি কিংবা তাল পাড়তে লম্বা গাছে উঠতে হিরোকে সবার আগে ডাকে গ্রামের মানুষ। পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরাও তার কাছে নতুন কিছু নয়। এতকিছুর বাইরেও তার দখল আছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বহু ইতিহাসে। গ্রামের মানুষ খবরের কাগজ পড়ে বা অন্যভাবে আলোচনা করলে কান পেতে শুনে থাকে হিরো। এমন সব বিস্ময়কর ঘটনা প্রসঙ্গে হিরো বলে, ‘চেষ্টা করলে কোন কাজই অসাধ্য থাকে না’। গ্রামের মিজানুর রহমান জানান, ‘এলাকার সবার কাজে হিরোর জুড়ি নেই। কেউ ডাকলেই সে সহায্য করতে এগিয়ে আসে।’
বৈদ্যুতিক কাজ করে মেজবা :
মিরসরাই পৌরসদরের মধ্যম মঘাদিয়া গ্রামের জামাল উল্ল্যাহর নয় সন্তানের সবার ছোট মেজবা উদ্দিন। জীবনে কখনো আলোর দেখা পায়নি। পড়াশোনা ভাগ্যে জোটেনি, তবে গ্রামের ফোরকানিয়া মাদ্রাসা থেকে নিয়েছে পবিত্র কোরআন শিক্ষা। স্বাবলম্বী হওয়ার যুদ্ধে নেমে মাত্র ১০ বছর বয়স থেকে শিখতে শুরু করে বৈদ্যুতিক কাজ। এখন তিনি সাবলীলভাবেই বিদ্যুৎ স ালন সংযোগ স্থাপন করছেন মানুষের ঘরে ঘরে। একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত কোন বেকায়দায় পড়তে হয়নি তাকে। এ ছাড়া সাবলীল ভাষা আর সুমধুর কণ্ঠে তার মাইকিং অন্যের মনযোগ আকর্ষণ করবেই। আচার-অনুষ্ঠান কিংবা নির্বাচনী প্রচারণায় মাইকিংয়ে মেজবার কদর বেশ ভালই।
একজন স্বাভাবিক মানুষের চাইতে মেজবা কোনভাবেই কম নয় মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে। একবার যার সঙ্গে কথা হয়েছে বহু বছর পরও তার কণ্ঠ গেঁথে থাকে মেজবার স্মৃতিতে। অন্যের ফোন নম্বর নিজের ফোনে স য় করা, স য়কৃত নাম্বারের তালিকা থেকে প্রয়োজনীয় নাম্বারটি বের করা, অপশনে গিয়ে দরকারি কাজ সারা সবই হয় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেজবাকে দিয়ে।
মেজবা জানায়, ‘আমি ছোট বেলা থেকে কিছু করার চেষ্টা করেছি। আমি জানতাম আমার পরিবার বেশিদিন আমার বোঝা বইতে চাইবেন না।’ বৈদ্যুতিক কাজের ঝুঁকি প্রসঙ্গে সে জানায়, ‘আমার কাছে ঝুঁকি মনে হয় না। ইলেক্ট্রিক কাজ করতে আমার ভাল লাগে।
মেজবাকে নিয়ে এলাকাবাসীর গর্বের শেষ নেই। সে গ্রামের সকলের কাছে বেশ প্রিয়। গ্রামের আলমগীর হোসেন বলেন, ‘মেজবা স্মৃতি শক্তি দেখে আমরা নিজেরাও মাঝে মাঝে হতবাক হয়ে পড়ি। সে মোবাইল কললিষ্ট থেকে নম্বর বের করে আমাদেরকে ফোন দেয়। এছাড়া গ্রামের দোকান-পাটে বসে নিজের মোবাইল ফোনে গান শুনে। খুব আশ্চর্যের বিষয়, মেমোরিতে থাকা গানের সেরাগুলোই বেচে বেচে শুনে সে এবং খুব ভালো গানও গাইতে পারে মেজবা।
জনতার আলো/ সোমবার, ০৬ মে ২০১৯/দানেজ
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.