জনতার আলো, নজরুল ইসলাম তোফা: মানব জাতির শিল্প চৈতন্য বোধ ও মনুষ্যত্ব বোধ বা মানুষের মানুষ ছাড়া অন্য কোনো পরিচয় আশা করা যায় না। আপাত দৃষ্টিতে সুচিন্তিত অভিমতের আলোকে দেখা যায় যে, তরুণ প্রজন্ম হতাশার কুয়াশায় উচ্চ আকাঙ্ক্ষার পথ যেন হারিয়ে ফেলছে। প্রত্যেকে নিজস্ব ভাবনার পক্ষে যে কোন যুক্তি উপস্থাপন করুক না কেন, ভাবনার এক বিস্তৃত পর্যালোচনায় উঠে আসে শিল্পীদের জীবিকা অর্জন কঠিন। এমন কঠিন ও অমশ্রিণ পথ রয়েছে বলেই কি শিল্প সাধনা করবে না তরুণ প্রজন্ম?
জানা দরকার, কিছুটা বিশৃঙ্খলা বা অসংগতি রয়েই গেছে দেশীয় শিল্পাঙ্গানে, অশিকার করার যে উপায় নেই। আবার বলা যায় কিছুটা বিশৃঙ্খলা ছাড়া শিল্প সংস্কৃতির বিবর্তনও ঘটে না। জীবিকা অর্জন কঠিন বলেই কি শিল্পীরা গরিব, দরিদ্র মানুষ হবে, তা কিন্তু নয়। মানুষ দরিদ্র হয়, যখন তাদের হৃদয়, কল্পনায়, সৃজনশক্তি কুঞ্চিত হয়ে যায়। এই কথা গুলো জানা গেলো, জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের অমিয় বাণীতে যা শিল্প চৈতন্যবোধের চিন্তায় তরুণ প্রজন্মের কাছে মাইলফলক হয়ে রবে।
শিল্প চর্চায় অর্থ উপার্জনের প্রয়োজন রয়েছে, অর্থ উপার্জন না হলে শিল্পচর্চার গুরুত্ব ও শিল্পের পরিধি বাড়ানো সম্ভব নয়। সেহেতু সৃৃৃজনশীল শিল্পীদেরকে একটু কৌশলী হতেই হবে। তবে ভিন্ন মতাবলম্বীরা হয়তো একে বাঁকা চোখে বা বাঁকা ভাবেই দেখবেন।আসলে অর্থ না পেলে যে শ্রমের স্বার্থকতা হয়ে যায় দুর্বিসহ। শিল্পের তথ্য ও তত্ত্বের ভিতর দিয়ে সযত্নে লালিত চিন্তা-চেতনায় এদেশের শিল্প সামনের দিকে এগুচ্ছে আবার বাধাও পাচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম চলতে গিয়ে যেন আবার সেই অর্থ কষ্টে হোঁচটও খাচ্ছে।তাদের শিল্প বিপ্লবে রয়ে যাচ্ছে সংশয়, তাদের পূর্ব বিশ্বাসের অসাড়তা দ্বারা তারা বাধা প্রাপ্ত হলেও নিত্য নবচিন্তা এবং চেতনায় নবউদ্দ্যমে আপন পথ খুঁজে নিচ্ছেন এবং নেবেও। শিল্পচর্চায় ধৈর্য তাদের যেন দিনে দিনে একটু কম হয়ে যাচ্ছে। এর কারণ তারা দাঁড় করাচ্ছেন মৌলিক চাহিদা শুধুই “অর্থ”।
ইতিহাসও বলে “অর্থ” উপার্জনের সুগম পথ অথবা প্রক্রিয়া একটু অমশ্রিণ। তাই তো এ পথে একজন শিল্পীকে যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, তা তো মোটেও যেন উপলব্ধি করছে না তরুণ প্রজন্ম। অর্থ উপার্জনের জন্য কষ্ট এবং শ্রম দিতেই হবে। সমাজ যদি সে অর্থ উপার্জনের পথ সুগম না করে বুঝতেই হবে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী শিল্পচর্চা হয়তো হচ্ছে না। ধরা যাক যে, অ্যাবসট্রাক্ট বা বিমূর্ত ধারার ছবি অঙ্কনের পদ্ধতি সমাজের সাধারণ মানুষ কতটুকুই জানে বা বুঝে। অ্যাবসট্রাক্ট কাজে যদি একজন শিল্পী শুরুতেই এমন ধারা শুরু করে, তা হলে শিল্পী খ্যাতি অথবা “অর্থ” চাওয়াটাই বৃথা চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়।
এ সম্পর্কে জনপ্রিয় শিল্পী মর্তুজা বশীর বলেছেন, অ্যাবসট্রাক্ট কাজে সমাজের প্রতি শিল্পীদের খুুুব একটা দ্বায়বদ্ধতা প্রকাশ পায়না। এখানে আরেকটা বিষয় উল্লেখ করা অনেকটাই জরুরী মনে করি। তা হলো, শিল্পীর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সঙ্গে যেন দর্শকের অভিজ্ঞতার বিস্তর পার্থক্য রয়েছে, তাই তরুণ শিল্পী হুবহু যে বার্তা অথবা দর্শনটি জানাতে চান, দর্শক কখনোই তার শতভাগ বুঝতে পারে না। শিল্পীর এই নিজস্ব অবস্থান ও জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই এমন পার্থক্য দেখা দেয়। আবার বলছি না যে, বিমূর্ত ছবি আঁকা যাবে না। অবশ্যই আঁকাতে হবে, তবে “অর্থ” উপার্জনের পথ খুঁজে নিয়েই সৃৃৃজন শীল কর্ম করা বাঞ্ছনীয়। সামাজিক চাহিদা অনুযায়ী আজকের এ তরুণ শিল্পীদের জীবন যাত্রার শুরুতেই রিয়ালিষ্টিক বা বাস্তবধর্মী ছবি অঙ্কনের প্রতি গুরুত্ব দেওয়াটাই যথার্থ।
সাধারণ মানুষের জন্যই সহজবোধ্য রুচিশীল এবং মন ছোঁয়ানো অথবা আবেদনময়ী ছবি অংঙ্কনেই আজকের শিক্ষানুরাগী তরুণ প্রজন্ম যুগোপযোগী শিল্পচর্চায় অগ্রসর হতে হবে। মনে রাখা দরকার যে, প্রত্যেককেরই একটি নিজস্ব স্টাইল বা সৃষ্টিশীলতা রয়েছে। তাই বলে শুরুতেই নয়। সামাজিক চাহিদা অনুযায়ী না এঁকে নাম ধামের জন্যই শুরু থেকে এই বিমূর্ত ধারণায় ছবি আঁকাটা ঠিক হবে না। শুরুতেই খ্যাতির জন্য আঁকা হলে অবশ্যই ধরাও খেতে হবে।এক সময় খ্যাতিটি আপনা আপনিই চলে আসবে। যদি সেই আর্ট বা চিত্রাঙ্কনটি সত্যিকার সামাজিক চাহিদার আর্ট হয়। হাজার বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি জনগোষ্ঠীর এমন এই শিল্প-সংস্কৃতি।
এ অভিজ্ঞতার আলোকে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অর্জন তার শিল্প বোধ, জীবন যাপনের পাশাপাশি নানাবিধ চিন্তা চেতনার মাঝেই রয়েছে রুচিশীলতা। এদেশের নারী-পুরুষের রুচিশীল এবং তাদের নিজস্ব স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইতিবাচক ভাবনার সংমিশ্রণ ঘটিয়েই শিল্প চর্চায় অগ্রসর হতে হবে। ফলে তা হতে পারে দুর্বল, অসুস্থ; হতে পারে পরিশীলিত, রুচিশীল। এটি নির্ভর করে, সেই জনগোষ্ঠীরা কীভাবে, কেমন করে গড়ে উঠছে তার মৌল সত্যের ওপর। মানুষ যদি আপন জীবনাচরণের মৌলিক যেসব গুণাবলি তাকে নির্ণয় করতে না পারে, তাহলে সেই খণ্ডিত বোধ তীব্রভাবে আঘাত করবে শিল্প, সংস্কৃতিকে। যদি পার্থক্য নির্ণয় করা না যায় ত্যাগ ও সহিষ্ণুতার, সাহস ও সন্ত্রাসের, শক্তি ও ক্ষমতার, বিনয় ও দম্ভের, সত্য ও মিথ্যার এবং রুচি ও অরুচির- তাহলেই তো বলা যায়, মূল্য বোধে ও আর্থিক দৈন্যতার ভিত নড়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। মূল্যবোধ ও আর্থিক চাহিদায় শিল্প সংস্কৃতির অনেক সহায়ক উপাদান। সুতরাং মূল্য বোধের অবক্ষয় দুর্বল করে শিল্প সংস্কৃতিক চেতনা। দুর্বল সাংস্কৃতিক চেতনায় পীড়িত করে জনগোষ্ঠীর মানবিক বোধ। তাই বিচক্ষণতার আলোকেই তরুণ প্রজন্মকে তাদের শিল্প সাধনায় অগ্রসর হয়েই অর্থ উপার্জনের পথ খুঁজতে হবে।
শিল্প সংস্কৃতি গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়।মানুষ ক্রমাগত নিজের বিকাশ ঘটাতেও পারছেন। দৈনন্দিন চারপার্শ্বে যা কিছু ঘটে যাচ্ছে, এগুলোকে দ্বায়িত্বে নেওয়াই শিল্পীর কাজ। শিল্পীর শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন শৈল্পিক চেতনার মধ্য দিয়েই মানুষের মনের খোরাক পুরনে এবং তাদেরকে শিল্পের পরিপূর্ণতা দিয়েই অর্থ উপার্জনের কথা ভাবতে হবে।
পরিশেষে বলা যায়, শিল্প থেকে আর্থিক উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম শিল্পী এবং দর্শকদের জানাশোনার পরিধির ওপর নির্ভর করেই শিল্প সৃষ্টি করতে হবে।কোন আঙ্গিক থেকে শিল্পটি উপস্থাপন করা হয়েছে তার উপরেই শিল্পের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চাহিদা রয়েছে বলে মনে করেন নজরুল ইসলাম তোফা। শিল্পী যত বিচক্ষণতার অধিকারী হবে ততই তার শিল্পকর্ম অর্থবহুল এবং অর্থ উপার্জনের পথ সুগম হবে। শিল্পী যদি সেই বিচক্ষণতার অধিকারী না হোন, তাহলে নিছক চিত্র এঁকে আর্থিক দৈন্যতায় থাকতে হবে। সুতরাং সেখানে অর্থ উপার্জনের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না বৈকি। শিল্পীর যদি দৃষ্টি এবং মননে সেই আবরণ বা পর্দাটা দিনে দিনে দূরীভূত হয়ে যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে তরুণ শিল্পীদের অন্তর দৃষ্টি এবং ভাবনার গভীরতা অনেক কম। তাই ধরেই নিতে হবে তরুণপ্রজন্মের শিল্পীদের অর্থ উপার্জনের পথ অমশ্রিণ।
নজরুল ইসলাম তোফা, টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট এবং প্রভাষক।
জনতার আলো/বুধবার, ০৭ মার্চ ২০১৮/শোভন
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.