জনতার আলো, লেখক, মোমিন মেহেদী : বাংলাদেশে তো অবশ্যই পাশাপাশি বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা বেড়েই চলেছে। এ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না মুক্তমনা লেখক-সাহিত্যিক-কলমযোদ্ধাগণও।
আর গত ১০ বছরে এটি অবাধ্য চক্র আকারেই ঘুরছে। টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের (সিপিজে) এর প্রতিবেদন দশম গ্লোবাল ইমপিউনিটি ইনডেক্স-২০১৭- অনুযায়ী সাংবাদিক নির্যাতনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এখন দশম। টানা তৃতীয়বারের মতো এ তালিকার শীর্ষে রয়েছে গৃহযুদ্ধকবলিত সোমালিয়া।
২০০৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে যেসব দেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, সেসব দেশকে এ তালিকার আওতায় আনা হয়েছে। নির্যাতনের ঘটনায় বিচার হয়নি এমন পাঁচ বা ততোধিক ঘটনাকে তারা নমুনা হিসেবে ধরেছে।
সিপিজে সাংবাদিক হত্যায় জড়িতদের দায়মুক্তির বিররুদ্ধে আন্তর্জাতিক দিবস উপলক্ষে সূচকটি প্রকাশ করেছে। গত এক দশকে বাংলাদেশে নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা ১১ জন। এসব হত্যাকান্ডে চরমপন্থি-জঙ্গী-ধর্মান্ধ সহ অন্য গোষ্ঠীরা জড়িত। হত্যাকান্ডের রাজনীতিতে তৈরি হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধকালিন সময়ে সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, কলামিস্ট জহির রায়হান, শহীদুল্লাহ কায়সারকে প্রথম সারির শিকার হিসেবে বেছে নিয়েছিলো স্বাধীনতা বিরোধীচক্র। সেই ধারা এখনো অব্যহত আছে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও সাগর রুণির পথ ধরে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হতে হচ্ছে সূবর্ণার মত অবিরত কাজ করে চলা সাংবাদিককে।
কারণ একটাই- সাংবাদিক হত্যা করলে বিচার নাই, শাস্তি নাই। একবারের জন্যও যদি কোন সাংবাদিক হত্যার বিচার কঠোরভাবে বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা হতো, তাহলে সবাই সতর্ক হয়ে যেতো, ভয় পেতো।
যখনই ঘটনা ঘটে, সাংবাদিক নির্যাতন বা হত্যায় জড়িতরা তখনই ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায়, যখন একটি দেশে সহিংসতাপূর্ণ পরিবেশ এবং গণমাধ্যমের ওপর ক্ষমতাসীনদের হুমকি থাকে। তারা সবসময় আইন-শৃঙ্খলা দুর্বল করে রাখতে চায়। এ ছাড়া কর্তৃপক্ষের চোখ এড়িয়ে বিভিন্ন দেশে উগ্রপন্থিরা হুমকি কিংবা সহিংসতা চালিয়ে যাচ্ছে।
এ প্রবণতার তালিকায় রয়েছে পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং নাইজেরিয়া। নির্যাতনের শীর্ষে থাকা সোমালিয়ায় গত এক দশকে দুই ডজনেরও বেশি সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। তাদের প্রাণ হারানোর জন্য দায়ী গৃহযুদ্ধাবস্থা এবং উগ্রপন্থিরা। বিশ্বময় অবস্থানের ভিত্তিতে যুদ্ধকবলিত সিরিয়া তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইরাক।
বর্তমানে রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট উগ্রপন্থি গ্রুপ ও জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) হুমকির মধ্যেই ইরাকে দায়িত্ব পালন করছেন সাংবাদিকরা।
রাজনৈতিক অস্থিশীলতার মধ্যে থাকা দক্ষিণ সুদান তালিকার চতুর্থ স্থানে আছে। এ ছাড়া ফিলিপাইন প ম, মেক্সিকো ষষ্ঠ, পাকিস্তান সপ্তম, ব্রাজিল অষ্টম, রাশিয়া নবম, নাইজেরিয়া ১১তম এবং ভারত ১২তম অবস্থানে রয়েছে।
সিপিজের সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবেদনে গত কয়েক বছর আফগানিস্তানের নাম থাকলেও এখন দেশটির নাম নেই। এদিকে জাতিসংঘও বিভিন্ন দেশের সরকারকে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা দিতে এবং হামলায় জড়িতদের বিররুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানিয়ে আসছে। একই আহবান জানাতে জানাতে ক্লান্ত বাংলাদেশে সাংবাদিক সমাজ।
বিশেষ করে অনলাইন প্রেস ইউনিটির প্রতিষ্ঠাতা ও ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে বলবো- বাংলাদেশকে ভালোবাসুন, বিচারের ব্যবস্থা করুন সাংবাদিক হত্যাকারীদের। তা না হলে এখন যেমন পাবনায় নারী সাংবাদিককে কুপিয়ে হত্যা করেছে, আগামীতে আরো ঘটতে পারে একই ঘটনা। আমরা এমন কোন নতুন ঘটনার পূণরাবৃত্তি চাই না। আর তাই চাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। সাগর-রুণি হত্যাকান্ডের পর ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটাম দিয়ে নির্বিকার হয়ে যাওয়ার মত কোন কথা শুনতে চাই না। চাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ, জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচার দেখতে। নির্মমতার গল্প যেন নির্মিত না হয় আর কোন নারী অধবা পুরুষ সাংবাদিকের মৃত্যুকে ঘিরে। তাই চাই প্রতিরোধ প্রতিনিয়ত। সরকার যদি আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসে সাংবাদিক হত্যা তো দূরের কথা নির্যাতনের কোন ঘটনাই আর ঘটবে না বলে বিশ্বাস করি আমি।
পারিবারিক হোক আর যে কারণেই হোক একজন সাংবাদিক থাকবে নিরাপদ, নিরাপত্তা দেবে বাংলাদেশ সরকার। এতটুকু চাহিদা দিনরাত দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করে চলা যে কোন সংবাদকর্মীর থাকতে পারে। আর সেই সুবাদে এই দাবী উপস্থাপন করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। আমরা ভুলে যাইনি যে, সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকান্ডের পাঁচ বছর পরও এই ঘটনার তদন্তে কোনো অগ্রগতির কথা জানাতে পারেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। র্যাবের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত এ পর্যন্ত ৪৮ বার সময় বাড়ালেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি। আমরা ভুলে যাইনি ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের একটি পাঁচতলা ভবনের প ম তলার ফ্ল্যাট থেকে মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ররুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। ওই বাসায় বাবা-মায়ের লাশের সঙ্গে শুধু তাদের শিশু সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘকেই পাওয়া গিয়েছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন তখন বলেছিলেন, “৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হবে।” পাঁচ বছর পার হতে চললেও কেন এই নৃশংস হত্যাকান্ড এবং কারা তা ঘটিয়েছে এর হদিস বের করতে পারেনি র্যাব বা পুলিশ। বিষয়টি নিয়ে বছরের পর বছর আন্দোলন করে যাচ্ছেন সাংবাদিকেরা। এক সময় লাগাতার আন্দোলন হয়েছে। এখন চলছে থেমে থেমে আন্দোলন। ভুলে যাইনি যে, মা-বাবার হত্যার বিচার চেয়ে মুখে কালো কাপড় বেঁধে মা-বাবা হত্যার প্রতিবাদ জানায় মেঘ। ফেব্রুয়ারি ১২, ২০১৫। মামলার বাদী নিহত রুনির ভাই নওশের আলী রোমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, “তদন্তে র্যাব-পুলিশের কোনো আন্তরিকতা আছে বলে মনে হচ্ছে না। পরিকল্পিতভাবেই এই হত্যা মামলা নষ্ট করা হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা সময়ে সময়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করে। কিন্তু তদন্তের অগ্রগতির কথা জানাতে পারেন না। শুধু ধৈর্য ধরতে বলেন।”
যদিও এ মামলায় ছয়জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঁচ বছর যাবৎ কারাগারে রাখা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন; সাগর-ররুনি যে বাড়িতে থাকতেন ওই বাড়ির নিরাপত্তা রক্ষী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামররুল হাসান অররুণ ও আবু সাঈদ। অন্যদিকে তানভীর রহমান ও ওই বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন নিয়েছেন। এমন নিরাপরাধী আর অপরাধীর পার্থক্য করার ক্ষমতা হারাতে থাকলে যত সাংবাদিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে অতিতে, তারচেয়ে অনেক বেশি ঘটনা ঘটবে হয়তো আগামী দিনগুলো। যদি তাই না হবে, তাহলে কেন ঝুলে আছে অন্তত ২০ সাংবাদিক হত্যাকান্ডের বিচার। ১৯৯৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ২২জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
সাগর-ররুনি ছাড়াও এ তালিকায় যারা রয়েছেন তারা হলেন; মোহাম্মদ কামররুজ্জামান, সাইফুল আলম মুকুল, মির ইলিয়াস হোসাইন, শামসুর রহমান, নহর আলি, হাররুনুর রশিদ, শুকুর হোসাইন, সৈয়দ ফাররুক আহমেদ, মানিক সাহা, হুমায়ুন কবির, কামাল হোসেন, দীপঙ্কর চক্রবর্তী, শহীদ আনোয়ার, শেখ বেলালউদ্দিন আহমেদ, গোলাম মাহফুজ, গৌতম দাস, বেলাল হোসেন দফাদার, জামাল উদ্দিন, তালহাদ আহমেদ কবিদ, সদরুল আলম।
এই তালিকা যেন আর লম্বা না হয়। একজন তথ্যযোদ্ধা হিসেবে বরাবরের মত অবিরত আবেদন করছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে আমাদেরকে মুক্তি দিন। তা না হলে একই ফাঁদে আটকে যেতে পারে যে কেউ। একই জালে তো বন্দী হতে পারেন যে কোন সাংবাদিক, তিনি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাই হন আর যত বড় সাংবাদিক নেতাই হনা কেন…
লেখক, মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ-এনডিবি
জনতার আলো/বৃহস্পতিবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮/শাহানা
Your email address will not be published. Required fields are marked *
Save my name, email, and website in this browser for the next time I comment.