২০২৩ আন্দোলনের পাশাপাশি বিএনপিতে ছিল গ্রেপ্তার ও সাজা আতঙ্ক


জনতার আলো প্রকাশের সময় : ডিসেম্বর ২৭, ২০২৩, ৬:২৫ পূর্বাহ্ন /
২০২৩ আন্দোলনের পাশাপাশি বিএনপিতে ছিল গ্রেপ্তার ও সাজা আতঙ্ক

জনতার আলো, স্টাফ রিপোর্টার: বছরের শুরু থেকে রাজপথে রাজপথে সরব থাকা বিএনপি কর্মীদের চাঙ্গা করতে সারাদেশেই বিক্ষোভ, সমাবেশ-মহাসমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। যা শুরু হয় গত বছরের ১০ ডিসেম্বরের ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশের মাধ্যমে।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগ থেকে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে পদযাত্রা, অবস্থান কর্মসূচি, গণ-

মিছিল ও রোড মার্চ কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে ব্যাপক সরগরম করে বিএনপি ও তার মিত্ররা। মূলত বছর জুড়েই আন্দোলনমুখী ছিলো বিএনপিসহ সমমনা জোটগুলো। আন্দোলনের পাশাপাশি সারাবছরই নেতাকর্মীদের মাঝে ছিল গ্রেপ্তার ও সাজা আতঙ্ক।

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় দলটির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে কঠোর হয়ে ওঠে সরকার। গ্রেপ্তার করা হয় দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ বিএনপির বেশ কজন সিনিয়র নেতাকে। গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যায় মাঠে সক্রিয় থাকা দলটির বহু নেতাকর্মী। সরকার পতনের আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে শেষপর্যন্ত নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দেয় বিএনপিসহ অন্তত ৬০টি দল।

২০২৩ সালকে চূড়ান্ত আন্দোলনের বছর টার্গেট করে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর ভেঙে দেওয়া হয় ২০ দলীয় জোট। এরপর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে জোট শরিকরা। শুরু থেকে ধারাবাহিকভাবে পদযাত্রা, অবস্থান কর্মসূচি, গণমিছিল ও রোড মার্চ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন হওয়ার পর চলতি বছরের ১২ জুন সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। একদফা ঘোষণা দেওয়ার পর কয়েকটি কর্মসূচি পালনের পর ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশের ঘোষণা দেয় দলটি। কিন্তু এ মহাসমাবেশ পুলিশ ও সরকার দলীয় বাধায় পণ্ড হওয়ার পর চলতি বছর প্রকাশ্যে আর কোনো সভা-সমাবেশ করতে পারেনি দলটি।

দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করে নির্বাচনের ঠিক ১৭ দিন আগে (২০ ডিসেম্বর) অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় বিএনপি। অসহযোগ আন্দোলনে বিএনপির মিত্ররাও সমর্থন জানিয়েছে।

এছাড়া, বছর জুড়ে কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে বিএনপি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ও রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সরকারের দেওয়া সংলাপ প্রত্যাখান করে দলটি। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন অংশ নেওয়ার বহিষ্কার করা হয় দলটির অসংখ্য নেতাকর্মীকে। এর আগে বহিষ্কার হওয়া নেতাদের দলে ফিরিয়ে আনার কথা থাকলেও তা প্রত্যাহার করা হয়নি। বছরের শেষ দুই মাস হরতাল-অবরোধেই ছিল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো।

বছরের শুরু থেকে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করে দলটি। তবে বিএনপির নেতারা গণ-অভ্যুত্থানের কথা বললেও জোরালো কর্মসূচি নিয়ে রাজনীতির মাঠে অবস্থান নিতে পারেনি দলটি।

বছরের শুরু থেকেই পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়তে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একাধিক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে বারবার বার্তা দেওয়া হয়। এমনকি নির্বাচনে বাধাদানকারীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করার নীতিমালাও ঘোষণা করে দেশটি। বিএনপিও বিদেশি কূটনৈতিকদের কাছে সরকারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে ধরে। বছরে শুরু থেকেই বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। এসব বৈঠকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন তারা। বিএনপির নেতারা কূটনীতিকদের জানান, নির্বাচন সামনে রেখে সরকার ভীতি সৃষ্টি করছে। নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যে মামলা, গ্রেপ্তার ও হামলা করা হচ্ছে। এ ছাড়া এই সরকার বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যবহার করছে।

নতুন রাষ্ট্রপতি ও ইসি কর্তৃক সংলাপের বিষয়টিও ছিল আলোচিত।

সরকারের পদত্যাগের পাশাপাশি নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নেওয়ার পর সংলাপ হতে পারে বলে জানিয়ে দেয় বিএনপি। এতে শর্তে সংলাপে রাজি হয়নি ক্ষমতাসীনরা। এ অবস্থায় গত ২৩ মার্চ প্রধান নির্বাচন কমিশনার সংলাপের আমন্ত্রণ জানালে সেটাও প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি ও মিত্ররা। বিএনপির শীর্ষনেতারা জেলে থাকা থাকা অবস্থায় গত নভেম্বরে আবারও সংলাপের বসার তাগিদ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। উভয়পক্ষ যার যার অবস্থানে অনড় থাকলে তা আর আলোর চেহারা দেখেনি।

২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পরদিন থেকে দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে দলটি ও তার মিত্ররা। ১২ দফায় ২৩ দিন অবরোধ এবং ৪ দফায় পাঁচ দিন হরতাল পালন করে বিএনপি। ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, ২৮ অক্টোবর থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে মোট ২৯৮টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এতে তিন শতাধিক যানবাহন ও ১৭টি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অগ্নিসংযোগকৃত যানবাহনের মধ্যে বাস ১৯৫টি, ট্রাক ৪৫টি, কাভার্ডভ্যান ২৩টি, মোটরসাইকেল ৮টি ও অন্যান্য ২৯টি গাড়ি রয়েছে। এসব ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলা করে পুলিশ। দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের গ্রেপ্তারে অভিযানে নামে র‌্যাব-পুলিশ। শুরুতেই দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর একে একে মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জহির উদ্দিন স্বপন, মজিবুর রহমান সারোয়ারসহ বহু নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়।

দলটির অভিযোগ, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে নেতাদের ওপর ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে নির্বাচনে অংশ নিতে চাপ প্রয়োগ করেছে। যারা সরকারের ভয়ভীতি ও টোপে পড়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে তাদের। দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমরসহ চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান, তাঁতীবিষয়ক সহসম্পাদক রাবেয়া সিরাজ, নির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আবু জাফর, শাহ শহীদ সারোয়ার, মতিউর রহমান মন্টু ও খন্দকার আহসান হাবিব ও এ কে এম ফখরুল ইসলাম এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

বছরটি কেমন গেল? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বলেন, দুঃখের সঙ্গে উল্লেখ করতে হচ্ছে, একটি শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের ভেতর দিয়েই বছরটি কাটাতে হয়েছে বাংলাদেশের ভিন্নমতাবলম্বীদের। বিগত বছরে নতুন করে জীবন দিতে হয়েছে ২২ জনকে যারা বছরব্যাপী সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ভেতরেও সরকারের আক্রোশের শিকার হয়েছেন।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে আগ্রাসী প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে বর্বর শক্তির প্রয়োগ করে কিভাবে একটি একতরফা নির্বাচন করে সরকার পুনরায় তাদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করবে, যা ছিল বছরটিতে সরকারের সার্বিক এজেন্ডা।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, জনগণের হারানো অধিকার ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে সারাবছর বিএনপির নেতাকর্মীরা সক্রিয় ছিল। তারা তাদের লক্ষ্য ও আদর্শ থেকে পিছপা হননি। অবিচলভাবে জুলুম-অত্যাচার সহ্য করে চলমান আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। এবং যতদিন কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারবে ততদিন তা অব্যাহত থাকবে।

জনতার আলো/বুধবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩/শোভন