ক্যাম্পাস

ধীরে ধীরে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে এগিয়ে শিবির, কেন পিছিয়ে ছাত্রদল?

  admin ১৬ অক্টোবর ২০২৫ , ১০:২৩ পূর্বাহ্ণ প্রিন্ট সংস্করণ

প্রান্ত পারভেজ : সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেলের অভাবনীয় বিজয় এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের শোচনীয় পরাজয় এক নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ডাকসু, চাকসুসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের নিরঙ্কুশ জয় একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অন্যদিকে, ছাত্রদলের ভরাডুবি দলটির ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এই বিশেষ প্রতিবেদনে ছাত্রশিবিরের উত্থান ও ছাত্রদলের বিপর্যয়ের কারণসমূহ সাধারণ মানুষের মতামত ও বিশ্লেষকদের দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা হলো।

ছাত্রশিবিরের অভাবনীয় সাফল্যের মূল কারণসমূহ:

​বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন ফলাফল বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞ মত অনুযায়ী, ছাত্রশিবিরের জয়ের পেছনে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে:

​দীর্ঘমেয়াদি ও সুসংগঠিত প্রস্তুতি: ছাত্রশিবির দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে। অন্যদিকে, অনেক ছাত্রসংগঠন স্বল্প প্রস্তুতিতে নির্বাচনে অংশ নিয়েছে।

​কৌশলগত অবস্থান ও জনসম্পৃক্ততা: জুলাইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর যখন শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে প্রচলিত ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, তখন শিবির কৌশলগতভাবে সরাসরি রাজনৈতিক পরিচয় সামনে না এনে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কার্যক্রমে যুক্ত ছিল। তারা হল ও ক্যাম্পাসকে ‘রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত’ রাখার পক্ষে প্রচার চালায়, যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করে।

​শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক ইশতেহার: ছাত্রশিবির ধর্ম, মুক্তিযুদ্ধ বা রাজনৈতিক মতাদর্শের পুরোনো বাইনারি বিভাজনের পরিবর্তে ছাত্রকল্যাণকে প্রাধান্য দিয়ে ইশতেহার তৈরি করেছে। তারা শিক্ষার্থীদের মৌলিক সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হওয়ায় ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছে।

ব্যক্তিগত ইমেজ ও আচরণ:

অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের মতো বিশ্লেষকরা মনে করেন, শিবিরের কর্মীরা ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি করলেও, তাদের একাডেমিক সাফল্য ঈর্ষণীয় এবং তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তুলনামূলকভাবে কম। এই ‘ইতিবাচক ইমেজ’ সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জনে সহায়ক হয়েছে।

প্যানেলে অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি:

ইসলামপন্থী ছাত্রসংগঠন হওয়া সত্ত্বেও তারা প্যানেলে ছাত্রী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধি রেখে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

ছাত্রদলের ভরাডুবির নেপথ্যে কী?

​অন্যদিকে, ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের বিপর্যয়ের পেছনে একাধিক কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে:

​দীর্ঘদিনের সাংগঠনিক অনুপস্থিতি: দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রদলের অনুপস্থিতি ছিল। ফলে মাঠ পর্যায়ে তারা সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। সস্বল্প ও অসম্পূর্ণ প্রস্তুতি: ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারাও স্বীকার করেছেন যে, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন নিয়ে তাদের সঠিক প্রস্তুতি ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিল না। দেরিতে প্যানেল ঘোষণার কারণে প্রচারণার গতিও শুরুতে ধীর ছিল।

পুরোনো ধারার রাজনীতি:

সাধারণ শিক্ষার্থীরা যখন নিপীড়ন ও নিবর্তনমূলক সংস্কৃতি থেকে মুক্তি চাইছিল, তখন ছাত্রদল পুরনো ধারার রাজনীতি বহাল রাখে। তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতির গতিপথ বুঝতে ব্যর্থ হয়।

​জনপ্রিয়তা হারানো: দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও, ছাত্রদল সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে তাদের মতাদর্শ সঠিকভাবে প্রচার করতে পারেনি। কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, পরিকল্পিতভাবে শিবির ছাত্রদলকে ছাত্রলীগের মতো ‘অজনপ্রিয়’ করার চেষ্টা করেছে।

কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মনোযোগের অভাব:

অভিযোগ রয়েছে যে, বিএনপির কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে সঠিক সময়ে সঠিক নির্দেশনা আসেনি, অথবা জাতীয় পর্যায়ের সংস্কার নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এতই ব্যস্ত ছিল যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে পর্যাপ্ত মনোযোগ দেওয়া হয়নি।

সাধারণ মানুষের মতামত:

​এই বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়।

​ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ছাত্রশিবির জেতার প্রধান কারণ তাদের সাংগঠনিক শক্তি এবং ছাত্রদের সমস্যার প্রতি মনোযোগ। আমরা দেখেছি, তারা দীর্ঘদিন ধরে নীরবে হলগুলোতে কাজ করেছে। অন্য দলগুলো, বিশেষ করে ছাত্রদল, অনেক দেরিতে মাঠে এসেছে, ততক্ষণে পরিবেশ শিবিরের অনুকূলে চলে গেছে।

​একজন অভিভাবক বলেন, “আমরা চাই, ছাত্র সংসদগুলো শুধু ছাত্রদের কল্যাণে কাজ করুক। শিবির যদি সন্ত্রাসমুক্ত ও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ দিতে পারে, তবে তারা ভালো করবে। ছাত্রদল কেন পারল না, তা তাদেরই ভাবতে হবে।

​একজন সাধারণ ভোটার মনে করেন, “এবারের নির্বাচন প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে এক নতুন ধারা তৈরি হচ্ছে। ধর্ম বা রাজনৈতিক পরিচয়ের চেয়ে এখন ছাত্রকল্যাণই মুখ্য। ছাত্রদলের উচিত ছিল আরও সুসংগঠিতভাবে ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে মাঠে নামা।

বিশ্লেষণ ও উপসংহার:

​ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোতে ছাত্রশিবিরের বিজয় এবং ছাত্রদলের ভরাডুবি বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতিতে এক নতুন মোড় এনেছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক আধিপত্য বা আদর্শগত স্লোগানের চেয়ে সুনির্দিষ্ট একাডেমিক ও হল-কেন্দ্রিক সমস্যা সমাধান, সুশৃঙ্খলতা, এবং দীর্ঘমেয়াদি সাংগঠনিক কৌশল এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রদল যদি নিজেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে না ওঠে এবং পরিবর্তিত ছাত্র সমাজের চাহিদা অনুযায়ী কৌশল গ্রহণ না করে, তবে তাদের জন্য সামনের দিনগুলো আরও চ্যালেঞ্জিং হবে। অন্যদিকে, ছাত্রশিবিরকে তাদের এই গণসমর্থন ধরে রাখতে হলে অবশ্যই তাদের ইশতেহারের প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন এবং শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

আরও খবর:

Sponsered content