ঢাকা, মঙ্গলবার, ডিসেম্বর ৩, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কোটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা

লেখক, বাদশাহ আব্দুল্লাহ

প্রকাশিত: ০৫ জুলাই, ২০২৪, ১২:২৫ এএম

কোটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা

কোটা নিয়ে দুশ্চিন্তায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা আবারও সরকারি চাকরিতে ৩০% কোটা বহাল থাকলো। বুধবার (৫ জুন ২০২৪) হাইকোর্ট এ রায় প্রকাশ করে। 

আদালত সরকারি চাকরিতে  মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালে যে  রায় প্রকাশ করেছে তা  বাতিলের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার (৬ জুন ২০২৪)  বিক্ষোভ হয়েছে। ২০১৮ সালে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে যে পরিপত্র জারি করা হয়েছিল, তার পুনর্বহাল দাবি করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।মুক্তিযোদ্ধা  কোটা পুনর্বহাল নিয়ে আদালতের রায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র  অসন্তোষ  সৃষ্টি হয়েছে।  

শুক্রবার (৭ জুন ২০২৪)  সকালে  জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান প্রধানের সাথে কোটা নিয়ে  আলোচনা করেছিলাম । তিনি বলেন, ❝আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে বলতে চাই যে, যেহেতু ২০১৮ সালে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাওয়ার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকার কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিল। তাই এটা নিয়ে আর প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি বর্তমানে হাইকোর্টের রায়ের ভিত্তিতে আবার কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই চায় যে, কোটাটা বাতিল করা হোক। কারণ, বাংলাদেশ হচ্ছে একটা প্রতিযোগিতার বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশে প্রতিটি শিক্ষার্থী চায় মেধার ভিত্তিতে, যোগ্যতার ভিত্তিতে সবাই যেন সঠিক জায়গায় যেতে পারে। আর যে কোটার কথা বলা হয়েছে ওতো মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০%। এটা নিয়েই সবার আক্ষেপ। কারণ, মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছিল মূলত দেশকে কোটাবিহীন, সাম্প্রদায়িকবিহীন করার জন্য। যেই দেশে কোনো বৈষম্য থাকবে না। এই কোটার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাচ্ছি, একটা বিরাট বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে যে, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে তারা দেশের সূর্যসন্তান। তাদেরকে অবশ্যই দেশের সবার দেখা উচিত।  সবাই সম্মানের চোখে দেখা উচিত। সরকার ও তাদেরকে সর্বাত্মক, সবদিক দিয়ে সহযোগিতা করুক। দেশের সর্বোচ্চ নাগরিকের সম্মান তাদেরকে দেওয়া হোক। এটা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন নাই। কিন্তু এই যে, তাদের সন্তান, নাতি-নাতনি তারা কেন এই সুযোগ- সুবিধা পাবে। কারণ হচ্ছে, তারাতো আর মুক্তিযুদ্ধ করে নাই। আর কথা হচ্ছে, কোটা থাকতে পারে, ওদেরকে যদি একটু সুবিধা দেওয়া হয় তাহলে কোটাটা থাকতে পারে ১০ থেকে ১৫%। কিন্তু একটা দেশের চাকরিতে যদি  ৫৬ % কোটা হয় তাহলে মেধাবীরা কোথায় যাবে? এদেশে তো আর মেধাবীরা থাকবে না। অবশ্যই প্রতিটা মেধাবী তখন বাইরের দেশে চলে যাওয়ার চিন্তা ভাবনা করবে। দেশে ভবিষ্যৎ সুনাগরিক ধরে রাখার জন্য, দেশের জ্ঞানী-গুণীদেরকে ধরে রাখার জন্য আমি মনে করি এই কোটার সংস্কার হওয়া জরুরি এবং বর্তমান সরকারে যারা উচ্চ পর্যায়ে আছে তাদেরকে এটা নিয়ে  আবারও ভাবা দরকার। কারণ হচ্ছে, যদি এই দেশের মেধাবী মুখ গুলো দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে এদেশে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।❞

বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান প্রধানের মতো দেশের ৯০-৯৫% শিক্ষার্থীদের মতামতও এমনই হওয়ার কথা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ  করে চাকরি নিয়ে শঙ্কিত রয়েছে দেশের ৯৫% শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। কারণ, দেশে সরকারি চাকরিতে কোটা থাকায় অনেক উচ্চশিক্ষিতরাও কাঙ্ক্ষিত  মেধা তালিকা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। হতাশায় দিনযাপন করছে তারা। কেউ কেউ কম বেতনেও বেসরকারি কোম্পানিগুলোতে  চাকরি নিচ্ছে। অনেকে আবার লোকলজ্জার ভয়ে হাত গুটিয়ে বেকার জীবনযাপন করছে। 

দেশে প্রতিনিয়তই বেকারত্বের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত দেশে বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। যা ২০২৩ সাল শেষে গড় বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার। গত বছরের তুলনায় বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি। 

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০০০ সালে সার্বিক বেকারত্বের হার ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০১০ সালে তা ৩ দশমিক ৪ শতাংশে দাঁড়ায়। ২০১৩, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের হিসাবে এই হার একই থাকে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)  এর ২০২২ সালের একটি  প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৩৬ লাখ মানুষ বেকার থাকবে। আইএলও, নিয়মিতই বাংলাদেশের  বেকারের সংখ্যা  নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে। 

দেশে বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করতেছে। প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী  উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা সমাপ্ত করে চাকরি পাচ্ছে না। এই বেকাররা দেশের জন্য  বোঝা হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। 

বর্তমান বাজেট  ২০২৪-২৫  এর ক্ষেত্রে ও দেখা যায়, বেকারদের জন্য তেমন  কোনো সুখবর নেই। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা থাকায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীরাও সুযোগ করে নিতে পারছে না।প্রতিযোগিতায় অনেক মেধাবীরাই পেছনে পড়ে যাচ্ছেঅন্যদিকে,  কোটা থাকায় সহজেই কিছু মানুষ সরকারি চাকরিতে সুবিধা ভোগ করছে। 

ধারণা করা যাচ্ছে, কোটা থাকায় দেশে বেকারত্বের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে যাচ্ছে। মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও বেশিরভাগ তরুণেরাই কোটা থাকায় সরকারি চাকরিতে সুযোগ পাচ্ছে না। এদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করা ৬০-৭০% শিক্ষার্থীই সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা। তাদের মা বাবার কতই না স্বপ্ন। 

সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে অবিচার করা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ❝দুই বিঘা জমি❞ কবিতায় দেখা যায় বাংলার গ্রামীণ সমাজের শ্রেণীবিভেদ। দুর্বলের উপর সবলের অবিচার। এ কবিতায় উপেন আক্ষেপ নিয়ে বলেছিল, 

❝এ জগতে, হায়, সেই বেশি চায়   আছে যার ভূরি ভূরি– রাজার হস্ত করে সমস্ত   কাঙালের ধন চুরি।❞

কবিতার লাইনটি  পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গরীব উপেনের সাথে জমিদার অন্যায় করেছে। জগতে যার যত বেশি সম্পদ আছে সে আরও বেশি সম্পদ  চায়।

তদ্রূপ, বর্তমানে বাংলাদেশে চাকরির ক্ষেত্রে ও বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা থাকায় কেউ সহজেই চাকরি পেয়ে যাচ্ছে আবার কেউ অত্যধিক মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও চাকরি পাচ্ছে না। এদেশের উচ্চ শিক্ষিত তরুণরা অনেকেই  বিদেশে চলে যাচ্ছে। এদেশে থেকে কি করবে তারা?

সরকার এমনিতেই মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সুযোগ সুবিধা দিয়েছে। তাতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু তাদের সন্তান, নাতি -নাতনি ও সুযোগ সুবিধা পাবে এটা নিয়েই অনেকের আক্ষেপ।  আর অন্যদিকে,দেশের ৯০-৯৫% শিক্ষিত তরুণরা কোটার কারণে সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কোটা নিয়ে বৈষম্য বন্ধের জন্য ২০১৮ সালে এদেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ফুঁসে উঠেছিল। 

 ২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় আকারের  আন্দোলন হয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবীর  পরিপ্রেক্ষিতে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে কোটা পুরোপুরি বাতিল করে সরকার। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত বা আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন করপোরেশনে চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি সংশোধন করে পরিপত্র জারি করে। তখন আন্দোলনরত সাধারন শিক্ষার্থীরা তা মেনে নিয়ে ছিলো। 

কিন্তু সম্প্রতি আবার হাইকোর্ট  সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০% পুনর্বহাল নিয়ে রায় প্রকাশ করায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের  মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। হয়তো,২০১৮ সালের মতো আবারও জোরালো আন্দোলনে নামতে পারে শিক্ষার্থীরা। এ আন্দোলন পূর্বের আন্দোলন থেকেও প্রকট হতে পারে। 

বাদশাহ আব্দুল্লাহ লেখক, গবেষক ও কলামিস্ট